‘একুশের চেতনা’ বলতে কী বোঝায় কিংবা বোঝানো হয় আমি বুঝি না। এটা আমার শিক্ষাদীক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণেও হতে পারে। তবে আমি একুশে ফেব্রুয়ারিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি ও পরবর্তী বাংলাদেশিদের ইতিহাসের একটি লাল তারিখ বলে মনে করি।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে শুধু পাঁচ জাতিরাষ্ট্রের একটি ভাষা বাংলাকেই বিপন্ন করেনি, তারা অন্য আর চারটি ভাষা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচ ও পশতুকেও বিপন্ন করেছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিয়ে।
না, ভাষা হিসাবে এখানে উর্দুর কোনো দোষ নেই-দোষ ছিল শাসকচক্রের ভুল সিদ্ধান্ত ও প্রক্রিয়ার। বাংলাদেশিরা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে এবং রক্তাপ্লুত আত্মদানের মধ্য দিয়ে বিপন্ন মাতৃভাষার মর্যাদা বীরোচিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। দেশের, রাষ্ট্রের পাঁচটি প্রধান ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করে লিংগুয়াফ্রাংকা হিসাবে উর্দুকে এমনকি বৈশ্বিক যোগাযোগের কারণে ইংরেজিকেও রাষ্ট্রভাষা করলে কোনো অসুবিধা ছিল না। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের আসামেও ভাষার দাবিতে মানুষ প্রাণ দিয়েছে। নানা দেশে, নানা কালে ভাষাকে নিয়ে অতীতে ছিনিমিনি হয়েছে এবং এখনো হয়ে চলেছে। আবার এও সত্য, ঔপনিবেশিক ভাষা ও সংস্কৃতি স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধনী ও বেগবানও করেছে। ফারসি ও আরবি আমাদের বাংলাকে নিত্য ব্যাবহারিক ও সাহিত্যিক ভাষা হিসাবে চলমান হতে সাহায্য করেছে। আর আমাদের আধুনিক বাংলা সাহিত্য তো ইংরেজি সাহিত্যেরই এক অলৌকিক অ্যাডাপটেশন।
এতক্ষণ আমার এ দু-চারটি কথার মধ্যে আমি যে ভাবনাটি জানাতে চাইলাম সেটি পাকিস্তানের শাসকদের ভাববার অবকাশ ছিল না, আমাদের শাসকদেরও নেই এবং আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের আর রাজনীতিকদেরও নেই। থাকলে একটা নেহায়েতই বাণিজ্যিক ‘বইমেলা’কে একুশের বইমেলা, প্রাণের বইমেলা, চেতনার বইমেলা বলে একটা উদ্ভট মাইন্ডসেট তৈরি করতেন না। আমাদের একুশের সঙ্গে বইমেলার কী সম্পর্ক? কোথায় ১৯৫২ আর কোথায় ১৯৭৩-৭৪ সাল। তো বইমেলা শুরু হয়েছে হোক, বাংলা একাডেমির ক্যাম্পাসে হচ্ছে তাতেও দোষের কিছু নেই; কিন্তু দোষের-আমার মতে, ভয়াবহ দোষের-কাজটি শুরু হলো বাংলা একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে যুক্ত করে। পৃথিবীতেই সব দেশে বইমেলা হয় প্রকাশকদের সমিতির উদ্যোগে একটি বাণিজ্যিক ইভেন্ট হিসাবে। ডিউরেশন পাঁচ কি সাত দিন। মেলায় পাঠক-দর্শকদের টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। সংশ্লিষ্ট দেশের কোনো ‘একাডেমি’ বইমেলার সঙ্গে যুক্ত, এটা কেউ চিন্তাও করতে পারে না।
বাংলা একাডেমির কাজ কী? আমাদের ক্রিয়েটিভ সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করা, দেশি ও আন্তর্জাতিক মুখ্য সাহিত্যিক-গবেষকদের এনে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা, দেশি-বিদেশি অনুবাদকদের দিয়ে একটি শক্তিশালী অনুবাদ সেল গঠন ও জারি রাখা এবং আমাদের সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের এবং বিশ্বসাহিত্যকে আমাদের সাহিত্যে পৌঁছে দেওয়া।
আমি বিষয়গুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষকে ভাবতে এবং বিবেচনা করতে অনুরোধ করব। বাংলা একাডেমির আদি ও মূল নীতিমালা অনুসরণ করুন, তাহলেই বাংলা একাডেমি তার স্বমহিমায় জেগে উঠবে। আরেকটি কথা, মেলার কর্তৃপক্ষ মেলাটিকে গ্রাম্য ও দৈশিক না রেখে আন্তর্জাতিক করে তুলুন। শুধু বাংলা কেন, যে কোনো ভাষার বইই মেলার বই হতে পারবে।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ
আপনার মতামত লিখুন :