ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসের ১৬ তারিখে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় বাঙালির স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ। আর এর স্থপতি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসতেন তার দেশ, তার বাংলা, বাংলাদেশকে। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় ছিল কেবলই বাংলাদেশ। এজন্য সারাজীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। ফাঁসির দড়িও তাকে লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি কখনো।
টানা ৯ মাস সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ফিরে আসেন তার প্রিয় জনগণের মাঝে। নিজেকে সঁপে দেন দেশ গড়ার কাজে। শুরু হয় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের সংগ্রাম। সেটা যেন আরেক সংগ্রাম। দেশের মানুষের অন্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সংগ্রাম।
সন্দেহাতীতভাবেই বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল তার দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একটা সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, যে সোনার বাংলার উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু সেই সোনার বাংলার স্বপ্নকে তার দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন।
আজ শেখ মুজিবের সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তারই কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশকে যিনি এরই মধ্যে নিয়ে এসেছেন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।
বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনসহ সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন। এর মধ্যে তিনি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিল্পকে। শিল্পে বিপ্লবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এ দর্শন বাস্তবায়নে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ।
বঙ্গবন্ধুর শিল্প ভাবনাকে পাথেয় করে ইতিবাচক মানসিকতায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তাই সবার আগে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর সেই শিল্প আন্দোলনকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে যথার্থ অর্থে কাজে লাগানো উচিতই। সেই পথ ধরেই এদেশে শিল্প উন্নয়ন হয়েছে তা অস্বীকার করারর কোন জো নেই। এ উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার আমাদেরও সকলে নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পরেছে।
শিল্প অন্তর্নিহিত শক্তিরকে কাজে লাগানো সে সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা অপরিহার্য হয়ে পরেছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক। দেশকে এগিয়ে নেয়ার অগ্রনায়ক। যার ভাবনা ছিল কেবল বাংলাদেশ। তিনি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলার প্রত্যেক মানুষের জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ভাবতেন দেশ কীভাবে সমৃদ্ধশালী হবে। তাইতো কৃষি ক্ষেত্রে মনোযোগী হন তিনি। শিল্প বিপ্লব ঘটাতে নানা পরিকল্পনা হাতে নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থমকে যায় তার সকল পরিকল্পনা।
আমরা সত্যি অকৃতজ্ঞ জাতি। যিনি আমাদের দেশমাতৃকাকে উপহার দিলেন, এই তাকেই কত না নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। জাতির জনকের বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হলো সেদিন। শিশু রাসেলের কান্না আর আকুতিও ওদের হৃদয় স্পর্শ করল না। শুধু তই নয়, হত্যাকারীরা তার কবর তিন মাস পর্যন্ত পাহারা দিয়েছে। সেখানে কাউকে আসতে দেয়া হয়নি। এমনকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ছবি এদেশে নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর কবর দেখতে না দেয়া, তার হত্যার ছবি প্রকাশের নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ঘৃণ্য হন্তারক ওই সামরিক শাসকরা তাতে ভয় পেত। তাদের ভয়টা ছিল এখানেই যে, তারা নিশ্চিত জানত জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা আরও জানত সে সময় এসব ছবি প্রকাশ পেলে কোনো কিছুতেই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সকলের প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব। ক্ষাত্র শক্তির সঙ্গে নৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব পৃথিবীতে এই প্রথম সংঘটিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে ঐক্য যে-শৃঙ্খলা যে-দুর্জয় সংকল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার তুলনা হয় না।
তারপর সেই ৭ই মাচের্র ভাষণ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যে শুনেছে সে ভাষণ তারই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ। কী ছিল সে ভাষণে? কোনো অজ্ঞাত তথ্য নয়, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘোষণা নয়, ভাষার কোনো কারুকার্য নয়, বলবার কোনো পরিশীলিত ভঙ্গি নয়। তাতে ছিল এ দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের অকথিত বাণীর প্রকাশ, তাদের চেতনার নির্যাস, বক্তব্যের অবিসংবাদিত আন্তরিকতা।
বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এই আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই তো শত্রু দেশে বন্দি থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রেরণা ছিল সক্রিয়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল সকলে তেমনি প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল তার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলার। বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি বলেছিলেন যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না। এই ছিল তার স্বপ্নেরই অংশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিশাল প্রতীক এবং নিরন্তর প্রেরণার উৎস। এইসব উপাদানের সমন্বয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং এই ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল সর্বোচ্চ স্থানটি যে বঙ্গবন্ধুর যুক্তিবাদী, বিচারশীল এবং ইতিহাস বোধসম্পন্ন সকল মানুষই এটা স্বীকার করবেন। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তবুও কিছু লোক বিতর্ক তুলেছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ক্ষমতার জোরে অন্যায়ভাবে বাতিলও করে দিয়েছেন। তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল অদূরদর্শী, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বিরোধী এবং ইতিহাসকে অস্বীকার করার নামান্তর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নানা অস্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের রাতে এই দিনটিকে ১৯৭৫ পরবর্তীকাল থেকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক নানা স্বার্থ, স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত এবং কিছু লোকের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে এটি সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন এই দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করল তখন তাকে সকল গণতান্ত্রিক, ইতিহাস বোধসম্পন্ন ও শুভবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত দলের মানুষেরই এটা মেনে নেয়া উচিত ছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রায় সিকি শতাব্দী সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন এবং তারই ফলে মানুষের মনে তার চিন্তা-চেতনা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং ধাপে ধাপে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনকে রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেন।
১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব। ক্ষাত্রশক্তির সঙ্গে নৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব পৃথিবীতে এই প্রথম সংঘটিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ঐক্য, যে শৃঙ্খলা, যে দুর্জয় সঙ্কল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার তুলনা হয় না। তারপর সেই ৭ মার্চের ভাষণ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যে শুনেছে সে ভাষণে তারই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ। কী ছিল সে ভাষণে? কোনো অজ্ঞাত তথ্য নয়, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘোষণা নয়, ভাষার কোনো কারুকার্য নয়, বলবার কোনো পরিশীলিত ভঙ্গি নয়। তাতে ছিল এ দেশের সর্ব শ্রেণির মানুষের অকথিত বাণীর প্রকাশ, তাদের চেতনার নির্যাস, বক্তব্যের অবিসংবাদিত আন্তরিকতা। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এই আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই তো শত্রু দেশে বন্দি থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রেরণা ছিল সক্রিয়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল সকলে, তেমনি প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল তার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলায় বিজয় এসেছে।
বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি স্বাধীন দেশ। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি দেশ সগর্বে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু এই অর্জনের নেপথ্যে যে মহান ব্যক্তিটির নিরঙ্কুশ অবদান তাকে ছাড়া কী এটি অর্থবহ হয়, নাকি হতে পারে? তাই গোটা জাতি অধীর অপেক্ষায় ছিলেন কবে ফিরবেন অবিসংবাদিত নেতা। কবে পূর্ণতা পাবে বাংলাদেশ নামের দেশটি স্বাধীনতা অর্জন। সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রাখলেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন-দিল্লি হয়ে আজন্ম লালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করেন পরম মমতায়। সেদিন স্বজন হারানো সর্বস্বান্ত মানুষ হৃদয় উজাড় করে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে বরণ করে নিয়েছিল। নেতা ও জনতা মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় যা স্মৃতির আকাশ থেকে কখনো মুছবার নয়।
বিশ্বে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এশিয়া মহাদেশে যে স্বল্প সংখ্যক ক্ষণজন্মা ও প্রকৃত অর্থে মানব প্রেমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় ও সফল ভূমিকা এবং অসামান্য অবদান লক্ষ্য করা যায়, তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল অন্যতমই ছিলেন না, সম্ভবত তার অবস্থান সবার শীর্ষে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে তার মতো এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিরল। তাইতো তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হয়।
তার জীবন ও রাজনীতি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও ক্রমবিকাশমান ধারায় ভৌগলিক সীমারেখায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালির হাজার বছরের লালিত আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ, সর্বোপরি আবহমান বাংলার বৈশিষ্ট্যকে তিনি নিজের জীবনে আত্মস্থ করেছেন। তার কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সব বিসর্জন দিয়ে তিনি দেশ স্বাধীন করেছেন। তার গড়া বাংলাদেশেই,বাঙ্গালী শত্রুই বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিন্তু মৃত বঙ্গবন্ধু শতগুণ আলোকিত হয়ে প্রতিটি বাঙালির মনে গ্রথিত হয়ে রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনবোধ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রদর্শন থেকে তার উন্নয়ন চিন্তা চেতনার কিছু উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। সামষ্টিক বিচারে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকারে মূল অনুষঙ্গ হলো তার দেশের মানুষ এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। গরিবহিতৈষী বঙ্গবন্ধু সেজন্যেই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন; পওে শিল্প বিপ্লবে হাত দেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। গরিব দুঃখী মানুষের মুখে হাঁসি ফোটানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনায় বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয় ভূমি ব্যবস্থাপনা,শিল্পের বিকাশ, ক্ষুদ উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান, সমবায় ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনা ও মানসম্পন্ন যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি।
মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারের ভূমিকা কেমন হবে? বিশ্ব মানের দক্ষ মানব সম্পদ বিভাবে গড়ে তোলা যায় । এ সব কর্ম পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিকে কীভাবে অর্থনৈতিক ভাবে পুনর্গঠন করা যায় তা ছিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। পরিকল্পনায় অতি নিম্ন আয় এবং সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত মানুষের জন্য বাস্তব সম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন-ই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
উন্নয়ন একটি ধীর ও বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া। বঙ্গবন্ধু সবাইকে নিয়ে একটি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নতুন নতুন শিল্প গড়ে বিপুল পরিমাণ বেকার ও অর্ধবেকার জনশক্তিকে উৎপাদনশীল কাজে লাগাবার সুপারিশ করা হয়। ঋণ বা অনুদান নির্ভরতায় নিরুৎসাহিত করা হয়। কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের সম্পসারনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। নতুন নতুন কর্মসংস্থান, শ্রম বাজার সৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ কারা হয়। কুটির শিল্পের মধ্যে হস্তচালিত তাত শিল্প, চামড়াজাত পণ্য, ধাতব পণ্য ইত্যাদি খাতে বিশেষ বিবেচনা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের কৃষি ও শিল্প বিপ্লব সেই সাথে বাঙ্গালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। উৎপাদন বৃদ্ধি,সুষম,বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করণ। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। এ দর্শনে ছিল সোনার বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখের হাঁসি ফোটানোর স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন গোটা অর্থনৈতিক- সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক নির্ভরতা থেকে মুক্তি। হয়তো সেটা স্বল্প সময়ে সম্ভব না ও হতে পারে, কিন্তু তা নিরাপদ ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে নিশ্চিতভাবে- এভাবেই চিন্তা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে আজকের বাংলাদেশ।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত ব্যক্তিখাত নির্ভর হলেও তাকে সহায়তার জন্যে জ্বালানীসহ মেগা অবকাঠামো খাত সরকারি বিনিয়োগেই গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ঘিরেই দেশে উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে আমরা ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮.২০ শতাংশ। শুধু প্রবৃদ্ধি নয় এদেশের বঞ্চিত জনদের জন্য ব্যাপক অংকের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। অতিদারিদ্র্যের হার আগামী কয়েক বছরেই কমিয়ে পাঁচ শতাংশের আশেপাশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
সবার জন্য পেনশন কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনাও তার রয়েছে। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটাই স্পষ্ট। শেষে একটা কথা বলতেই হয়, বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু জাতিকে যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন, তা সফলতা পেতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ এখন তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। তার যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব এবং দূরদর্শী পরিকল্পনা, সময়োপযোগী পদক্ষেপেই বাংলাদেশ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে।
মধ্যম আয়ের দেশটি এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেই বলেছিলেন, ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে,স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না’। এই ছিল তার স্বপ্নেরই অংশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পরে স্বপ্ন দেখা মানুষ গুলো। তিনি চলে গেলেন। আর ফির এলেন না। আফসোস, এমন একটা নেতা এদেশের আর জন্মায়নি একটিও। তার মতো করে বাংলাকে আর ভালোবাসবেনি কেউ; কেউ দেশের মানুষকে তার মতো করে আগলে রাখেনি। হে মহান নেতা ভালো থাকো, স্বর্গীয়সুখে থাক। হাজারো সালাম তোমায়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
আপনার মতামত লিখুন :